আমার স্বর্গে পূর্ণ গ্রহণ
প্রকাশিত : ১৬:০৮, ৩১ মে ২০২০
ছোটবেলা থেকেই স্বর্গের নাম শুনে আসছি, বড়দের কাছে এর অনেক বর্ণনা ও গল্প শুনেছি। এরপরে একটু বড় হয়ে ধর্ম বইয়ে স্বর্গ নরকের বর্ণনা পড়েছি। এতগুলো উৎসের সারসংক্ষেপ হিসেবে আমার মনের মধ্যে স্বর্গের যে রূপ অংকিত হয়েছে তা হলো,এটা সব সৌন্দর্যের সেরা সুন্দর, আর সব আনন্দের সেরা আনন্দ স্থান। এখানে কোন দুঃখ,কষ্ট, জড়া, ব্যাধি নেই, সব পুণ্যাত্মারা এখানে সুখে আনন্দে দিন কাটায়।
আমার এই মধ্যবয়সী জীবন পর্যন্ত বেশি দেশভ্রমণ বা স্থানীয় বিভিন্ন জায়গা ভ্রমণের তেমন সৌভাগ্য হয়নি। তাই হয়তো আমি 'ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া 'ধানের শীষের উপরের ছোট্ট শিশির বিন্দু দেখেই তা থেকে স্বর্গীয় আনন্দ খুঁজে নিতে বেশি পছন্দ করি। আমাদের বাসা থেকে বের হয়ে বাদিকে প্রায় এক কিলোমিটার পথ গেলেই স্প্রিংফিল্ড-ফ্রাঙ্কোনিয়া মেট্রো স্টেশন। এপথে আমি আট বছর ধরে প্রতিদিন (শীতকাল ব্যতীত) একবার কখনো দুবার সকালে ও বিকালে হাঁটতে যাই।আমার অতি প্রিয় এপথ ছোটবেলার কল্পনার সেই স্বর্গের মতোই সুন্দর।
প্রথমে কিছুদূর এঁকেবেঁকে চলা তারপরে সোজা পিচ ঢালা মাঝারি ধরনের চওড়া রাস্তা। এ সময় রাস্তার দুপাশ সবুজ ঘাস ও নানা রঙের ঘাসফুলে ভরে যায়। কিছুদূর গেলেই ডানপাশে ব্লু বেরি গাছ যেগুলো এখন সাদা সাদা ফুলে সেজে আছে, আর বাদিকে জুঁই ফুলের মতো অনেক জায়গা জুড়ে সাদা ফুল। এ গুলো সন্ধ্যা বেলায় ফোটে আর একত্রে এত ফুলের সুগন্ধ আমাকে স্বর্গের রাজধানী অমরাবতীর কথাই মনে করিয়ে দেয়। এর পর একটু এগিয়ে গেলেই কাঠের ব্রিজ যার ডানদিকে রয়েছে লেক। যদিও এ লেকের কিছু অংশে পানি আবার কিছু অংশ শুকনো তবুও এর সার্বিক সৌন্দর্য স্বর্গের মন্দাকিনী নদীর চেয়ে সম্ভবত কম নয়। লেকের একপাশ খালের মত চিকন হয়ে ব্রিজের নিচ থেকে বাদিকে বয়ে গেছে। ব্রিজের ওপর দাঁড়ালে নিচ থেকে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ পানিতে ছোট ছোট মাছ, পিঠের ওপর সবুজ শেওলা পড়া বড় কচ্ছপ, তার সাথে ছোট ছোট বাচ্চা, গুইসাপ দেখা যায়। লেকের বড় চেপ্টা অংশে দেখা যায় অনেক পরিযায়ী পাখি, বুনো হাঁস, বক ইত্যাদি। ব্রিজের ওপর দঁড়িয়ে রুটি, বিস্কুট বা যে কোন খাবার দিলে সব শ্রেণির প্রানিই কাছে চলে আসে। এদের কোন ভয় নেই,এরা স্বর্গের অভয়ারণ্যে বাস করে। কেউ এদের মারেনা, তাড়া করে না, বরং আদর করে, ছোট বাচ্চারা অনেক সময় এদের সাথে খেলাও করে।প্রতিদিন দেখতে দেখতে এরাও মানুষের মতোই বন্ধু হয়ে উঠে।
একটু এগিয়ে গেলেই বাদিকে মেট্রো ট্রেন ঝিক ঝিক শব্দ করে আসছে আর যাচ্ছে অবিরাম গতিতে। আর ডানদিকে নানারঙের ফুলে সজ্জিত বিস্তৃত বন।বিরাট এ বনটাকে মনে হয় আমার পার্থিব স্বর্গের নন্দন কানন যেখানে মৌমাছি, ভোমরা আর প্রজাপতিরা গাছ থেকে গাছে, ফুল থেকে ফুলে উড়ে বেড়ায়। । আর একটু এগিয়ে গেলেই লেকের বাকি অংশ দেখা যায়। এর মাঝখানে গোলাকার দ্বীপের মত উঁচু জায়গা যেখানে রয়েছে গাছপালা, ঝোপঝাড়। দলবদ্ধ হরিণ পরিবারগুলো লেকের শুকনা অংশে নেমে নতুন গজানো এক ধরনের সবুজ পাতা, গুল্ম খায়। অনেক সময় একদম রাস্তার কাছে চলে আসে এরা। ডাকলে কান খাঁড়া করে তাকিয়ে দেখে। যদি ধরার জন্য একটু এগিয়ে যাই অমনি দু তিন লাফেই বনের ভেতরে ঢুকে পড়ে।
কয়েকদিন পরেই পাকা ব্লু বেরিতে গাছ গুলো নুয়ে পড়বে। পথচারীরা অনেকেই ব্লু বেরি তুলে খায়। আমি যখন বেরি তুলতে যাই, মনে পড়ে ছোটবেলার সেই পিচফল,বৈচি, বড়ৈ তোলার কথা।এগুলো খেলে পিচফলের মতোই জিহবা নীল হয়ে যায়, আর বৈচি গাছের মত এগাছে কাঁটা ও আছে প্রচুর। এখানে হাঁটতে গেলে আমি আবার শৈশবের সেই পুরো আনন্দটাই ফিরে পাই, ফিরে পাই আমার কল্পনার স্বর্গ।
প্রতিবছর এ পথে হাঁটতে গিয়ে আমাদের নেইবারহুডের অনেকেই বন্ধু হয়েছে। বিকেলে একটা নির্দিষ্ট সময় আমরা যার যার ঘর থেকে বের হই। পথে দেখা হয় সবার সাথে। বাংলাদেশি এখানে তেমন নেই। তাই কথা ইংরেজিতে বলতে হয় বলে ইংরেজি শিক্ষাটা ও সাথে সাথে হয়।আমরা দেখা হলে প্রথমে হাই, হেলো বলি, কখনো হাগ দেই, হ্যন্ডশেক করি। তারপরে একত্রে দলবেঁধে আমাদের স্বর্গের রাস্তায় ভ্রমণ করি। যার যার পেটের সারাদিনের কথা ভুল ভাল ইংরেজিতে অনর্গল বলতে থাকি। এদেশের হোয়াইট বা ব্লাকরা আমাদের কথা ভালো বোঝেনা। তাই তাদের সাথে কথা বলতে হয় বুঝে শুনে। আর আমার মত এশীয়ান যারা, যে যত আগে এসেছে সে তত ভালো ইংলিশ বলে। এভাবে আমরা দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় স্বর্গীয় পরিবেশে হেসে খেলে আনন্দ উপভোগ করি।
সন্ধ্যা হতে না হতেই আবার ঘরে ফেরার পালা। পশুপাখিরা ও এ সময় যার যার ঘরে ফেরে। তাই চোখে দেখার চেয়ে কানে শোনার উপলব্ধিই বেশি হয় এ সময়। ব্যাঙগুলো জোরে জোরে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর শব্দ শুরু করে, মনে হয় যেন তারা সমবেত সঙ্গীত গাচ্ছে, আর ঝিঝি পোকারা ঝি ঝি রবে সেই গানের সাথে তান ধরে। পাখিরাও গাছে গাছে তাদের নিজ নিজ বাসায় গিয়ে কচর কচর করে সারাদিন কে কি করেছে, খেয়েছে, আরো কত কী মনের কথা যার যার ভাষায় বলে যাচ্ছে।ঘরে ফিরতে ফিরতে আমার বন্ধুরা ও সবাই যার যার গলিতে মোর নিচ্ছে, আর চলে যাচ্ছে
এ বছর বসন্ত এসেছে পুরো আড়াই মাস হয়ে গেল। লকডাউনের জন্য প্রথম দু মাসে কেউ ঘর থেকে বের হয়নি। তারপরে আস্তে আস্তে দু চারজন বের হতে শুরু করেছে। এক সপ্তাহ ধরে আমিও যাওয়া শুরু করেছি। তবে চিত্র সম্পুর্ন ভিন্ন এখন।
আমাদের স্ব সৃষ্ট স্বর্গ এখন দুঃখ, জড়া, ব্যাধিতে থুবড়ে পড়েছে। উর্বশী আর হুরপরীদের আনন্দ উল্লাস, সুখ, দুঃখের অভিব্যক্তি মাস্ক দিয়ে ঢাকা এখন। এখন আর লিপস্টিকের ও দরকার হয়না, সুন্দর হাসিমুখ করে হাঁটার ও দরকার হয় না। যার যেভাবে ইচ্ছা, যখন ইচ্ছা একা একা হাঁটে।অনেকেই এখন বের হচ্ছে, কিন্তু জীবন বাঁচাতে সবাই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে ব্যস্ত। কাউকে দেখলেই মনে করে করোনা আসছে, আর রাস্তা ছেড়ে দ্রুত গতিতে ঘাসে বনে নেমে পড়ে। মানুষগুলো ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে সামাজিক আচার নিয়ম ভুলে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতে।
সেদিন আমার এক শ্রীলঙ্কান প্রতিবেশী শান্তির সাথে দেখা হলো। দুজনের ই মাস্ক গলায় ঝুলানো ছিল বলে চিন্তে কষ্ট হয়নি।এ বছর শীতের পরে এই প্রথম দেখা হলো বলে দুজন দুজনের কাছে দৌড়ে গেলাম। একটু কিছু বলতে না বলতেই শান্তি 'আই নো, আই নো' করতে করতে দৌড় দিয়ে রাস্তার পাশে ঘাসের উপর পড়লো। দুজন রেল লাইনের মত রাস্তার দুপাশে ৬ ফুট সমান দূরত্ব রেখে কিছুক্ষণ কথা বললাম। শান্তি বুনোহাঁসের জন্য কিছু রুটি নিয়ে এসেছিলো। হাঁসগুলো ওকে খাবারসহ দেখে দৌড়ে এলো। রুটি টুকরো করে দিচ্ছে আর হাঁসগুলো খাচ্ছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখার পর যে যার পথে আবার চলে গেলাম।
স্বাস্থ্য রক্ষার প্রয়োজনে প্রতিদিন একই পথে হাঁটি। রাস্তার সৌন্দর্য, পরিবেশ, গাছপালা, পাখপাখালি সবকিছু আগের মতোই আছে, শুধু পুণ্যাত্মাদের পুণ্য ফুরিয়ে গেছে বলে তাদের আনন্দের পরিবর্তে সংগী সাথীর অভাবে নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে। তাই একা একা হাঁটি আর মনে মনে বলিঃ
সেই স্বর্গ,অমরাবতী, নন্দন কানন,
যেখানে যা ছিল, আছে আগের মতন।
রাহু সম করোনার হলো আগমন,
রাজা রাণী সহ কাঁপে হুর- পরীগন।
অপেক্ষায় আছি কবে মাস্ক, গ্লাভস, ফেলে,
সবাই হাসবো, গাব, মন প্রাণ ঢেলে।
শ্বাস নেবো বুক ভরে হাতে হাত রেখে,
ধরায় নামবে স্বর্গ আনন্দ দেখে।
লেখক: সোনালী দাস, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী, শিক্ষক, ফেয়ারফেক্স কাউন্টি পাবলিক স্কুল।
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।